বরিশালে রাজাকারের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার নাম,বিক্ষোভ সমাবেশ
বরিশালে মুক্তিযোদ্ধা তপন কুমার চক্রবর্তী, তার মা উষা রানী চক্রবর্তীসহ অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের নাম রাজাকারের তালিকা থেকে বাতিলের দাবিতে বরিশালে বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল করেছে বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)।
এ উপলক্ষে মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) বেলা ১২টায় বাসদ বরিশাল জেলা শাখার আয়োজনে দলীয় কার্যালয় থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়।
মিছিলটি নগরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে অশ্বিনী কুমার হলের সামনে সদর রোডে গিয়ে শেষ হয়। পরে সেখানে আয়োজিত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন- রাজাকারের তালিকায় নাম আসা মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট তপন কুমার চক্রবর্তী, তার মেয়ে জেলা বাসদের সদস্য সচিব ডা. মনীষা চক্রবর্তীসহ দলীয় নেতাকর্মীরা।
বক্তব্য শেষে সমাবেশস্থলেই সম্প্রতি মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত রাজাকারদের বিতর্কিত তালিকা পুড়িয়ে প্রতিবাদ জানানো হয়।
এর আগে বেলা সোয়া ১১টার দিকে নগরের ফকিরবাড়ি রোডে জেলা বাসদের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন ডা. মনীষা চক্রবর্তী ও তার মুক্তিযোদ্ধা বাবা।
লিখিত বক্তব্যে মনীষা চক্রবর্তী বলেন, বিজয় দিবসের ৪৮ বছরে এসে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে এক ন্যাক্কারজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হলো আমাদের। এই রাজাকারদের তালিকা প্রনয়ণ হওয়ার কথা ছিল মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পরপরই। কিন্তু বিজয়ের ৪৮ বছর পর সেই তালিকা তৈরির নামে জাতি মুখোমুখি হলো এক মর্মান্তিক প্রহসনের।
‘আমার বাবা অ্যাডভোকেট তপন চক্রবর্তী একজন সর্বজনপরিচিত গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা এবং ঠাকুরদা অ্যাডভোকেট সুধীর কুমার চক্রবর্তী মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি মিলিটারির হাতে শহীদ হন। কিন্তু বাবাকে রাজাকারের তালিকায় ৬৩ নম্বর এবং ঠাকুমা শহীদ সুধীর কুমার চক্রবর্তীর স্ত্রী উষা রাণীকে ৪৫ নম্বরে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এটি শুধু একটি মুক্তিযোদ্ধা শহীদ পরিবারের সঙ্গেই নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সব মানুষের জন্যই লজ্জাজনক ঘটনা। বরিশালে গণমানুষের অধিকার নিয়ে লড়াইয়ের দল বাসদের সদস্য সচিব হিসেবে আমার পরিবারের সঙ্গে ঘটা এ ঘটনাকে আমরা সম্পূর্ণরূপে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেই মনে করি।’
‘ঠাকুরদা সুধীর কুমার চক্রবর্তীকে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ১২ আগস্ট পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বাসা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে ওয়াপদা বধ্যভূমিতে হত্যা করে। তাঁর লাশ পর্যন্ত পরিবারকে দেয়া হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের পর তাকে শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ঠাকুরদার মৃত্যুর পর আমার বাবা ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ট্রেনিংয়ের জন্য ভারতে যান। ২২ দিন ট্রেনিং শেষে অক্টোবর মাসে দেশে ফিরে তিনি ৯ নম্বর সেক্টরে সাতক্ষীরা, খুলনা ও বরিশাল জেলায় সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।
যুদ্ধরত অবস্থায় ৮ ডিসেম্বর তিনি বরিশালে প্রবেশ করেন। যুদ্ধকালীন সময়ে তিনি বেশ কয়েকটি সম্মুখ সমরে সরাসরি অংশ নেন এবং জীবন বাজি রেখে দেশের জন্য যুদ্ধ করেন। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করেন এবং মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত গেজেটে তাঁর নাম প্রকাশিত হয়। বরিশালের মুক্তিযোদ্ধাসহ সর্বস্তরের মানুষের কাছে বিষয়টি সর্বজনস্বীকৃত।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত গেজেটে ৪১১২ পৃষ্ঠায় ১১১ নম্বর তালিকায় তপন কুমার চক্রবর্তী ও তার পিতা শহীদ সুধীর কুমার চক্রবর্তীর নাম অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। এমনকি স্বীকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মানস্বরূপ তিনি ভাতাও পেয়ে আসছেন।’
‘আবার শহীদ সুধীর কুমার চক্রবর্তীর সহধর্মিনী উষা রানী চক্রবর্তীকে রাজাকারের তালিকায় ৪৫ নম্বরে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। প্রগতিশীল নারী উষা রানী ছিলেন বরিশালের আইএ পরীক্ষায় প্রথম ফার্স্ট ডিভিশন পাওয়া নারী শিক্ষার্থী। তিনি ২০০৪ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী প্রগতিশীল ও বিদুষী নারী হিসেবে সবার কাছে বরেণ্য ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সুকৌশলে একুশে পদকপ্রাপ্ত নিখিল সেনকে পাকহানাদার বাহিনীর হাত থেকে রক্ষাও করেছিলেন তিনি।
বিজয় দিবসে দেশের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ করা এই মানুষগুলোকে রাজাকারের তালিতায় অন্তর্ভূক্ত করার বিষয়টি আমাদের সবাইকে স্তম্ভিত করেছে, ক্ষু্ব্ধ করেছে।’
মনীষা চক্রবর্তী বলেন, বরিশালে ক্ষমতাসীন দলের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে বাসদই একমাত্র সোচ্চার কষ্ঠস্বর হওয়ায় আমাদের ওপর নানাবিধ দমন-পীড়ন চালানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এবারে আমার পরিবারের সদস্যদের রাজাকারের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করার বিষয়টি আমাদের কণ্ঠরোধের প্রয়াসেরই এক নগ্ন ও ন্যাক্কারজনক রূপ বলে আমরা মনে করছি।
‘আমরা মনে করি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের জন্য রাজাকারদের তালিকা প্রণয়ন করা অত্যন্ত জরুরি। আমাদের দল থেকে আমরা বিভিন্নসময় রাজাকারদের তিন স্তরের তালিকা করার জন্য সরকারের কাছে প্রস্তাবনা দিয়েছি। কিন্তু ১৫ ডিসেম্বর যে রাজাকারের তালিকা মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় প্রণয়ন করেছে তার মধ্যে আমার বাবা ও ঠাকুমা ছাড়াও সারা দেশে ভাষাসৈনিক, মুক্তিযোদ্ধাসহ নানান নির্দোষ ব্যক্তির নাম সংযুক্ত করা হয়েছে।
এই প্রশ্নবিদ্ধ তালিকায় রাজাকারের বিচার করা দূরে থাক, উল্টো বিতর্ক তৈরির মধ্য দিয়ে বিচারের বিষয়টি প্রলম্বিত করে রাজাকারদের পুনর্বাসনের রাস্তাই সহজ করবে বলে আমরা মনে করি। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় যেভাবে তাদের গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদেরকে কোনো রকম যাচাইবাছাই ছাড়াই গেজেটভুক্ত রাজাকার বানিয়ে দিল, সেই প্রক্রিয়াটিরও আমরা তদন্ত দাবি করছি। রাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের এই বিতর্কিত তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করায় জড়িত ব্যক্তিদেরও দৃষ্টান্তমূলক শান্তি দাবি করছি আমরা।’
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত থাকা মনীষার বাবা মুক্তিযোদ্ধা তপন কুমার চক্রবর্তী বলেন, এই তালিকায় আমার নাম এসেছে এটা শুনেই তো আমি হতভম্ব। এখানে মেয়ের রাজনৈতিক বিষয়সহ আরো বিষয় থাকতে পারে। তবে অন্যায় ও মিথ্যের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাবো। এ ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের যেমন বিচার করতে হবে,
তেমনি রাজাকারের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের নাম প্রকাশের ঘটনায় তাদের জাতির কাছ ক্ষমাও চাইতে হবে। শুধু আমি বা আমার মা নই তালিকায় আরো অনেক মুক্তিযোদ্ধার নাম এসেছে। এর মধ্যে মিহির দত্ত ও তার বাবার নামও রয়েছে।
এদিকে তালিকায় মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখা সেরনিয়াবাত পরিবারের প্রয়াত সদস্য আব্দুল হাই সেরনিয়াবাতের নামও রয়েছে। এ নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় সুশীল সমাজের নেতারা।