কৃষকের ছেলে থেকে প্রধানমন্ত্রী হয়ে শান্তিতে নোবেল
ইথিওপিয়ার সংস্কারপন্থী প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ ২০১৯ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার জিতেছেন। মূলত দুই দশক ধরে প্রতিবেশী ইরিত্রিয়ার সঙ্গে চলা যুদ্ধের অবসান ও দেশটির মধ্যে জাতিগত সংঘাত নিরসনের ইথিওপিয়ার আমূল সংস্করের কারিগর হিসেবে তাকে এবার শান্তিতে নোবেল দেয়া হয়েছে।
নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি এবারের পুরস্কারের জন্য আবি আহমেদের নাম ঘোষণা করে বলেছে, শান্তি প্রতিষ্ঠা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রতিষ্ঠায় তার ভূমিকা, বিশেষ করে প্রতিবেশী ইরিত্রিয়ার সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে চলা সীমান্ত সংঘাত নিরসনে তার যে ভূমিকা মূলত সেটাকেই পুরস্কৃত করা হলো।
তবে আবি আহমেদের ক্ষমতায় আসার বেশিদিন হয়নি। গত বছরের এপ্রিলে তিনি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ক্ষমতা গ্রহণের ছয় মাসের মাথায় গত বছরের জুলাইয়ে ইরিত্রিয়ার সঙ্গে চুক্তি করেন। যার জন্য তিনি আন্তর্জাতিক প্রশংসা কুড়িয়েছেন।
প্রতিবেশী ইরিত্রিয়ার সঙ্গে ১৯৯৮ থেকে ২০০০ সালের সীমান্ত যুদ্ধের পর গত ২০ বছর ধরে দেশটিতে অচলাবস্থা চলছিল। আবি আহমেদ ক্ষমতায় আসার পরপরই সেই অচলাবস্থার নিরসন করেন। প্রতিবেশী দুই রাষ্ট্রের ওই যুদ্ধ-সংঘাতে প্রাণ হারিয়েছেন ৭০ হাজারের বেশি মানুষ।
আবি আহমেদ ইথিওপিয়ার কাফা প্রদেশের বেশাহাসা নামক ছোট্ট এক শহরে ১৯৭৬ সালের ১৫ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা আহমেদ আলি হলেন দেশটির মুসলিম ধর্মাবলম্বী অরোমো জাতিগোষ্ঠীর। আর মা টেজেতা ওলডে। যিনি একজন খিস্টান ধর্মাবলম্বী।
তার কৃষক বাবার স্ত্রী ছিলেন চারজন। মোট ১৩ ভাইবোনের মধ্যে আবি আহমেদ হলেন সবার ছোট। তার মায়ের যে ছয় সন্তান ছিল তাদের মধ্যেও সর্বকনিষ্ঠ তিনি। তাইতো পরিবারে অভাব অনটনের মধ্য দিয়ে বড় হতে হয়েছে তাকে। ঘরে থাকার জায়গা না পেয়ে ঘরের বারান্দায় ঘুমিয়েছেন।
আবি আহমেদে রাজনীতিতে সক্রিয় হন ২০১০ সালে। তার আগে তিনি আফ্রিকার আরেক দেশ রুয়ান্ডায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনের দূত হিসেবে কাজ করেন। রাজনীতিতে এসেই মানুষের কথা বলে তিনি জনপ্রিয় হয়ে যান। ২০১৬ সালে পান ইথিওপিয়ার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব।
গরিব কৃষকের সন্তান থেকে গোয়েন্দা কর্মকর্তা হওয়া আবি আহমেদ আফ্রিকার দ্রুত বর্ধমান অর্থনীতির সংস্কারের নেপথ্য নায়কে পরিণত হয়েছেন। ৪৩ বছর বয়সী এই আফ্রিকান নেতা নিজ সমাজ ব্যবস্থাকে একটা বড় পরিবর্তনের দিকে নিয়ে গেছেন। তাইতো তার নোবেল প্রাপ্তির খবরে দেশে উৎসব শুরু হয়েছে।
নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটিও আবি আহমেদের এ অবদানের কথা উল্লেখ করে বলেছে, ‘যখন আবি প্রধানমন্ত্রী হলেন তখন তিনি স্পষ্ট ঘোষণা দিলেন যে প্রতিবেশী ইরিত্রিয়ার সঙ্গে শিগগিরই শান্তি আলোচনা পুনরায় শুরু করবেন। ইরিত্রিয়ার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কাজ করে তিনি খুব দ্রুত একটি চুক্তিতে পৌঁছান।’
ক্ষমতায় এসেই তিনি বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের কেবল কারাগার থেকে মুক্ত করে দিয়েই ক্ষান্ত হননি, তাদের ওপর চালানো রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ও নৃশংসতার জন্য ক্ষমাও চেয়েছেন। এছাড়া তার পূর্বসূরি যাদের সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে দেশ ছাড়া করেছিল, সেই সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যদের তিনি দেশে স্বাগত জানিয়েছেন।
২০১৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ক্ষমতাসীন জোটের নেতা হেইলেমারিয়াম হঠাৎ জোটের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়তে বাধ্য হন। হেইলেমারিয়ামের পদ ছাড়ার পরই তার উত্তরসূরি হিসেবে ক্ষমতা পান অরোমো ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ৪২ বছর বয়সী আবি।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণের পর সরকারে বেশ কিছু পরিবর্তন আনেন। ওয়েবসাইট ও টেলিভিশন চ্যানেলও অবরোধমুক্ত করেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রতিজ্ঞা করেন, তিনি একটি নতুন ইথিওপিয়া উপহার দেবেন। সব জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধি নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় সমতা আনবেন।
রাষ্ট্র পরিচালনায় সমতা আনার ঘোষণার প্রমাণ স্বরূপ তিনি নির্বাচিত হয়ে যে মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন তার অর্ধেক ছিল নারী। যা দেশটির ইতিহাসে বিরল। এমনকি প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি একজন নারীকে মনোনীত করেন। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির চেয়ারেও বসান একজন নারীকে।
২০০৪ সালে দেশটির বিরোধী দলের গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী বিরতুকান মিদেসকাকে বন্দী করা হয়। ১৮ মাস জেলে থাকার পর থেকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত হন। আবি আহমেদ ক্ষমতায় এসেই তাকে দেশে ফিরে আসার অনুরোধ করেন। দেশে ফিরলে তাকে জাতীয় নির্বাচন কমিশনের প্রধান করেন আবি আহমেদ।
আফ্রিকায় তার মতো নেতা খুব বেশি দেখা যায়নি। মহাদেশটির সবচেয়ে কমবয়সী নেতা হলেও কাজের মাধ্যমে আফিকার গন্ডি ছাড়িয়ে নিজেকে পরিচিত করেছেন একজন বিশ্বজনীন নেতা হিসেবে। যুদ্ধ আর ক্রমবর্ধমান হারে জাতিগত সংঘাত বাড়তে থাকা একটা দেশকে নতুনের দিশা দেখিয়েছেন তিনি।
তথ্যসূত্র : গার্ডিয়ান, বিবিসি, রয়টার্স, উইকিপিডিয়া