বরিশালে স্বামীকে হত্যার চেষ্টা : স্ত্রী-প্রেমিকসহ গ্রেফতার-৩
শামীম আহমেদ ॥ প্রেমিক ও তার বন্ধুর সহায়তা স্বামীকে হত্যার উদ্দেশ্যে চেতনাশক খাইয়ে কুপিয়ে গুুেত্বর জখম করেছে স্ত্রী। ঘটনাচক্রে স্বামীকে জীবিত উদ্ধার করে হাসপাতলে ভর্তি করা হয়। আর ঘটনার সাত দিনের মধ্যে হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী ভিকটিমের স্ত্রী রাবেয়া আক্তার মুসকান, তার প্রেমিক আবু সাইদ সিয়াম (২০) ও বন্ধু জিহাদ হাসান রাজন(১৭)কে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
এরমধ্যে সিয়ামের আদি বাড়ি গৌরনদী ও রাজনের আদি বাড়ি জামালপুরে হলেও তারা গাজীপুরের টঙ্গীর দত্তপাড়া এলাকায় বসবাস করতো। আজ বুধবার (০১ ফেব্রয়ারি) দুপুরে জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বরিশালের পুলিশ সুপার ওয়াহিদুল ইসলাম-বিপিএম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, গত ২৫ জানুয়ারি সন্ধ্যা পৌনে ৭ টার দিকে গৌরনদী মডেল থানাধীন কালনা এলাকায় রাস্তার ওপর সৌরভ বেপারী নামে এক যুবককে অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা কুপিয়ে গুরুত্বর আহত করে পালিয়ে যায়। যাকে পরবর্তীতে উদ্ধার করে বরিশাল শের ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এবং সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় প্রেরণ করা হয়।
এ বিষয়টি জানতে পেরে গৌরনদী সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এসএম আল বেুেনী, গৌরনদী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোঃআফজাল হোসেন, পরিদর্শক (তদন্ত) মোঃ হেলাল উদ্দিনের নেতৃত্বে একটি চৌকস টিম ঘটনার মূল রহস্য উদঘাটন ও হামলাকারীদের সনাক্তের কাজ শুরু করে।
পুলিশ সুপার জানান, তদন্তের শুরুতেই বিভিন্ন তথ্য ও সন্দেহজনক আচরণ পরিলক্ষিত হওয়ায় ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী ভিকটিমের স্ত্রী রাবেয়া আক্তার ওরফে মুসকানকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়। প্রথমে মুসকান এলোমেলো তথ্য প্রদান করলেও পরবর্তীতে সে ঘটনার বিবরণ সেচ্ছায় প্রদান করেন।
ওইসময় মুসকান জানায়,ভিকটিম সৌরভ বেপারীর সাথে সাড়ে তিনমাস পূর্বে পারিবারিক ভাবে বিবাহ হয় মুসকানের। বিয়ের সময় সৌরভ বলেছিলো, সে সরকারি চাকুরি করে এবং মুসকানকে উচ্চ শিক্ষা গ্রহনের সুযোগ দিবেন। তবে বিয়ের পর মুসকান জানতে পারে সৌরভ সরকারি চাকুরি নয় ঢাকায় প্রাইভেট ব্যাংকের গাড়ি চালক।
অপরদিকে বিয়ের পর মুসকানের পূর্বের বন্ধুবান্ধবের সাথে সম্পর্কের বিষয় ও সাংসারিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সৌরভের মনোমালিন্য দেখা দেয়। যা নিয়ে মুসকান তার স্বামী সৌরভের ওপর ক্ষুব্দ হয় এবং বিয়ের পূর্বের সম্পর্কিত প্রেমিক আবু সিয়াম ও তার বন্ধু রাজনদের সহযোগীতায় হত্যার পরিকল্পনা আটে।
পুলিশ সুপার বলেন, গত ২৪ জানুয়ারি ছুটিতে সৌরভ ঢাকা থেকে গৌরনদীতে গ্রামের বাড়িতে আসে। পরের দিন দুপুরের খাবার গ্রহনের পর সৌরভকে ভিটামিন ওষুধ বলে দুটি চেতনানাশক ওষুধ খাওয়ায় মুসকান এবং বিকেল সাড়ে ৪ টার দিকে কেনাকাটার জন্য সৌরভের সাথে মুসকান গৌরনদী উপজেলা সদরে যায়। সৌরভের কাছ থেকে নগদ টাকা ও মোবাইল ফোন নিয়ে মুসকান একটি পার্লারের ভেতরে যায় এবং কৌশলে মোবাইল ফোনে পুরতান প্রেমিক সিয়ামকে খবর দেয়।
পার্লারের কাজ ও কেনাকাটা শেষে ঘন্টাখানেক পরে সৌরভ অসুস্থবোধ করলে, মুসকান তাকে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। পথিমধ্যে সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টার দিকে বান্ধবীর বাসায় যাওয়া কথা বলে অটোরিক্সা থেকে মুসকান তার স্বামী সৌরভকে নিয়ে নেমে যায়।
পরবর্তীতে গৌরনদীর কালনা এলাকার শামসুল হকের বাড়ির পূর্ব পাশ্বের রাস্তা দিয়া পায়ে হেটে যাওয়াার সময় সৌরভ বেপারীকে স্ত্রী মুসকানের প্রেমিক সিয়াম ও রাজন ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যার উদ্দেশ্যে এলোপাথারি কুপিয়ে জখম করে। এতে সৌরভের গলার উপরের অংশে, ঘাড়ের নিচের অংশে, গালে, কানে সহ দুই হাতে রক্তাক্ত জখম হয়।
আর হামলার এসময় স্ত্রী মুসকান স্বামীকে বাঁচানোর চেষ্টা করে নীরবে রাস্তায় দাড়িয়ে থাকে। তবে গুরুত্বর আঘাতপ্রাপ্ত সৌরভের ডাকচিৎকারে আশপাশের লোকজন এগিয়ে আসলে হামলাকারীরা দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করে।
এ ঘটনায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সৌরভ বেপারীর বাবা গৌরনদী মডেল থানায় যে মামলা দায়ের করেন সেই মামলায় মুসকানকে গ্রেফতার দেখিয়ে গত ২৮ জানুয়ারি আদালতে সোপার্দ করা হয়। তখন সে ঘটনার বিবরণ দিয়ে ১৬৪ ধারা মোতাবেক দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেন।
যার প্রেক্ষিতে পুলিশ পরিদর্শক(তদন্ত) মোঃ হেলাল উদ্দিন, এসআই মোঃ কামালহোসেন, এএসআই মোঃ ফারুক হোসেনসহ গৌরনদী মডেল থানার একটি আভিযানিক দল গতকাল ৩১ জানুয়ারি গাজীপুর মেট্রোপলিটনের টঙ্গী পূর্ব থানাধীন দত্তপাড়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে আবু সাইদ সিয়াম (২০) ও জিহাদ হাসান রাজন(১৭)কে গ্রেফতার করে। তাদের দেয়া তথ্যানুযায়ী হামলায় ব্যবহৃত রক্তমাখা চাপাতী ও ছোরা ঘটনাস্থলের রাস্তার পাশের ঝোপ ঝারের মধ্য থেকে উদ্ধারও করা হয়।
আজ বিকেলে তাদের আদালতে সোপার্দ করা হবে জানিয়ে পুলিশ সুপার ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, মুসকান স্বীকার করে পুরো ঘটনা তার সাজানো ছিলো, তবে সে চায়নি সৌরভকে এভাবে হত্যার উদ্দেশ্যে কুপিয়ে মুমুর্ষ অবস্থা করা হোক। তবে সৌরভের সাথে বুনিবনা না হওয়া মুসকান চেয়েছিলো ভয়ভীতি দেখিয়ে তালাক নিয়ে প্রেমিক সিয়ামকে বিয়ে করতে।
গ্রেফতার আবু সাইদ সিয়াম ও জিহাদ হাসান রাজনের কিশোর গ্যাং এর সাথে জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে জানিয়ে বলেন, সমাজের কিশোর গ্যাং অপরাধী এবং উচ্চ বিলাসী চরিত্রের মেয়েদের জন্য এ ধরনের ঘটনা হয়তো ঘটছে। পরিবারের অভিভাবকদের প্রতি অনুরোধ আপনারা খেয়াল রাখবেন আপনার সন্তান কার সাথে মিশছে, সম্পর্ক করছে, কোথায় যাচ্ছে। কারন আমরা মনে করি সৌরভের মৃত্যু হলে বরগুনার রিফাত হত্যার মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি আবার ঘটতো হয়তো তার থেকেও জঘন্য কিছু ঘটতো।
এদিকে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ঢাকার হাসপাতালের মুমুর্ষ অবস্থায় চিকিৎসাধীন সৌরভের বাবা কবির বেপারী বলেন, বিয়ের সময় আমরা কোন মিথ্যাচার করিনি, মুসকান মিথ্যে বলছে। তার আচরণ শুরু থেকেই সন্দেহজনক ছিলো। আমি এ ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই, যাতে কারও সন্তানের সাথে এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।