খামারির কাছে যাবে মোবাইল ভেটেরিনারি ক্লিনিক, লাগবে না কোনো অর্থ
গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য বিমোচন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে পশুপাখিপালন। গ্রামে অনেকেই পশুপাখি পালন করে বাড়তি আয় করেন। আবার অনেকে বাণিজ্যিকভাবে গড়ে তুলেছেন বড় খামার। এভাবে দেশে প্রাণিসম্পদ খাতের সমৃদ্ধি ঘটলেও তাৎক্ষণিক চিকিৎসার অভাবে মারা যায় অনেক পশুপাখি। উপজেলা প্রাণিসম্পদ হাসপাতালে চিকিৎসা সুবিধা থাকলেও দূরত্বের কারণে সেবাবঞ্চিত হন অনেক খামারি।
তবে এসব সমস্যা নিরসনে খামারির দোরগোড়ায় পশুর চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দিতে দেশের ৬১ জেলার ৩৬০টি উপজেলায় চালু হচ্ছে ভ্রাম্যমাণ প্রাণিচিকিৎসা ক্লিনিক। ফলে পশুর চিকিৎসায় খামারির দোরগোড়ায় চিকিৎসকসহ পৌঁছে যাবে এই ভ্রাম্যমাণ ক্লিনিক। এজন্য ব্যয় করতে হবে না কোনো অর্থ, বিনামূল্যেই সেবাটি পাওয়া যাবে।
জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে ৬১টি উপজেলার খামারিদের দোরগোড়ায় আধুনিক ও জরুরি প্রাণী চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মোবাইল ভেটেরিনারি ক্লিনিক বিতরণ কার্যক্রম আগামীকাল বুধবার (৯ ফেব্রুয়ারি) আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হবে। পরে ধাপে ধাপে ৩৬০টি উপজেলায় এটি চালু হবে। প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের (এলডিডিপি) আওতায় এ সেবাটি পরিচালিত হচ্ছে। প্রাণীর চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সার্ভিসগুলোর সমন্বয়ে একটি গাড়ি কাস্টমাইজ করে পেছনের অংশে একটি স্টিলের বক্স থাকবে। পোর্টেবল মেশিনগুলো এ গাড়িতে থাকবে। গাড়ির গায়ে লেখা থাকবে ‘মোবাইল ভেটেরিনারি ক্লিনিক’। গাড়ির মাঝের অংশে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ভেটেরিনারি সার্জনকে নিয়ে বসবেন। সামনের ড্রাইভারের পাশে একজন কম্পাউন্ডার বা ড্রেসার থাকবেন। গাড়িতে জরুরি সেবার মেশিন যেমন থাকবে তেমনি ওষুধও থাকবে। তাই প্রয়োজন হলে চিকিৎসক যেন তাৎক্ষণিক সহায়তা দিতে পারবেন।
এলডিডিপি প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ অর্থায়নে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের বাস্তবায়নাধীন প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পটিতে (এলডিডিপি) মোট বিনিয়োগ ৪ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের বিনিয়োগ ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা প্রাণিসম্পদ সেক্টরে সর্ববৃহৎ বিনিয়োগ। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে শুরু হওয়া পাঁচ বছর মেয়াদি এ প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে। প্রকল্পের মাধ্যমে দেশে দুধ ও মাংসের উৎপাদন বৃদ্ধি, গাভী-ষাঁড়, ছাগল-ভেড়া এবং হাঁস-মুরগির উৎপাদন বৃদ্ধি, প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি প্রদর্শনী দ্বারা খামারিদের দক্ষতা উন্নয়ন, দুগ্ধ বিপণনের জন্য বাজার সংযোগ, পণ্য বহুমুখীকরণ, মূল্য সংযোজন, স্থানীয় পর্যায়ে উদ্যোক্তা উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি, প্রাণিজাত আমিষের উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি ফুড সেফটি নিশ্চিতকরণে উৎপাদনকারী, পরিবহনকারী, ব্যবসায়ী, কারিগর, ভোক্তা সব স্তরে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করছে এ প্রকল্প।
প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানান, পশুপাখি পালনে গত এক যুগে অনেক দূর এগিয়েছে বাংলাদেশ। উন্নত জাতের গরু, ছাগল, মহিষ, ভেড়া, হাঁস, মুরগি, কবুতর ও টার্কির খামার বাড়ছে দিন দিন। আগে চাষাবাদে সহায়তা আর দুধ, ডিমের প্রয়োজনে এবং অনেকটা শখেরবশে গ্রামের বাড়ির উঠানের কোনায় এসব পশুপাখি লালনপালন করা হতো। এখন সেখানে বৃহৎ পরিসরে এবং বাণিজ্যিকভাবে উন্নত জাতের গবাদিপশুসহ হাঁস-মুরগি উৎপাদন ও বিপণন করা হচ্ছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের শত শত ভেটেরিনারি চিকিৎসক ও বৃহৎ কর্মী বাহিনী জেলা, উপজেলা ও মাঠ পর্যায়ে নিয়মিত সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। সরকার থেকে বিনামূল্যে পশুপাখির বিভিন্ন রোগের টিকা, চিকিৎসা এবং ওষুধও দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু গাভীর প্রসবকালীন জটিলতায় তাৎক্ষণিক সেবা দেওয়ায় তেমন কোনো সুব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির জরুরি চিকিৎসাসেবা দেওয়ার লক্ষ্যে বিশেষ ধরনের অ্যাম্বুলেন্সের কথা ভাবা হয়েছে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে। কিন্তু মানুষের মতো পশুপাখিকে, বিশেষ করে উন্নত জাতের বড় আকারের প্রাণীকে তো আর অ্যাম্বুলেন্সে করে চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে আসা সহজ কথা নয়।
সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে উন্নত দেশের আদলে দেশে প্রথমবারের মতো মোবাইল ভেটেরিনারি ক্লিনিক বা ভ্রাম্যমাণ প্রাণিচিকিৎসা ক্লিনিকের মাধ্যমে পশুপাখির চিকিৎসাসেবা সহজীকরণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। উপজেলাভিত্তিক এ ভ্রাম্যমাণ ক্লিনিকগুলো গ্রামগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলে জরুরি চিকিৎসা ও পরামর্শসেবা দেবে। দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরে ফোন করলেই এখন থেকে খামারিদের দোরগোড়ায় দ্রুত পৌঁছে যাবে আধুনিক এ ক্লিনিক।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ভ্রাম্যমাণ প্রাণিচিকিৎসা ক্লিনিকগুলোতে থাকবে রোগ নির্ণয়ের যন্ত্রপাতি, ওষুধ এবং চিকিৎসাসামগ্রী। জরুরি চিকিৎসার পাশাপাশি চিকিৎসক এবং দক্ষ কর্মীরা ক্লিনিক-ভ্যানে চেপে রুটিন করে নিজ উপজেলার অন্তর্ভুক্ত ইউনিয়ন ও গ্রামগুলোতে নিয়মিত পরিদর্শনে যাবেন এবং চিকিৎসা, ওষুধ, পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দেবেন। দেশের ৬১টি জেলার ৩৬০টি উপজেলায় শিগগির এই ভ্রাম্যমাণ প্রাণিচিকিৎসা ক্লিনিকের কাজ শুরু হচ্ছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের বাস্তবায়নাধীন এলডিডিপি প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, টিকা ও অন্যান্য ওষুধপত্রসহ ভ্রাম্যমাণ ক্লিনিকগুলো সরবরাহের ব্যবস্থা করেছে। এরই মধ্যে ৬১টি ক্লিনিক প্রস্তুত করা হয়েছে। অবশিষ্ট ক্লিনিকগুলোও শিগগির উপজেলাগুলোতে পাঠানো সম্ভব হবে বলে প্রকল্প দপ্তর থেকে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা আশা প্রকাশ করে বলছেন, এটি বাস্তবায়ন হলে খামারিদের পশুপাখির জরুরি চিকিৎসার জন্য কোনো দুশ্চিন্তা থাকবে না। প্রাণিসম্পদের চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসক ও কর্মীদের পক্ষে এ ক্লিনিকের সাহায্যে দ্রুত ও বেশি সংখ্যক পশুপাখি স্বাস্থ্যসেবার আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হবে। এখন থেকে খামারিরা আর নিজেকে একা মনে করবেন না। তাদের আত্মবিশ্বাস, বিনিয়োগ এবং উৎপাদনও বৃদ্ধি পাবে বহুলাংশে। সেই সঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঘোষিত ‘ওয়ান হেলথ’ অর্থাৎ মানুষ, প্রাণী ও পরিবেশের জন্য একই রকম সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার পথে একধাপ এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।
প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের (এলডিডিপি) চিফ টেকনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর ড. মো. গোলাম রাব্বানী জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের ডিমার্টমেন্ট যে সার্ভিসগুলো দিয়ে থাকে তার মধ্যে অন্যতম ভেটেরিনারি সার্ভিস বা চিকিৎসাসেবা। চিকিৎসাসেবার জন্য চিকিৎসক যেমন প্রয়োজন, পাশাপাশি কিছু লজিস্টিক সাপোর্ট প্রয়োজন। কারণ প্রাণীর এক্স-রে, আলটাসনোগ্রাম লাগতে পারে। অর্থাৎ সেই লজিস্টিক সাপোর্ট ছাড়া একজন চিকিৎসক ফুল এফিসিয়েন্সি দেখাতে পারবে না। এজন্য একটা হাসপাতাল লাগে, এটি হলো উপজেলা প্রাণিসম্পদ হাসপাতাল। কিন্তু একটা প্রান্তিক খামারির অসুবিধা হলে তার অসুস্থ প্রাণীটি হাসপাতালে নিয়ে আসাটা দুরূহ ব্যাপার। যখন চিকিৎসক মোটরসাইকেল নিয়ে যান তখন এত লজিস্টিক সাপোর্ট সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবেন না সেখানে। সে কারণে আমি মোবাইল ভেটেরিনারি ক্লিনিক সার্ভিসটা ডেভেলপ করতে চাচ্ছি। তাহলে চিকিৎসক সব লজিস্টিক সাপোর্টসহ অসুস্থ প্রাণীর সেবা দিতে তাদের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাবে, ইমার্জেন্সি যে সার্ভিসটি দরকার হবে সেটির ক্ষেত্রে এই সার্ভিসটি ভূমিকা রাখবে।
তিনি আরও বলেন, এটা যেমন চিকিৎসাসেবা খামারির দোরগোড়ায় নিয়ে যাবে, তেমনি সার্ভিস যিনি প্রোভাইড করছেন তার মোবিলিটিটা বাড়বে। আমরা তিনধাপে ৩৬০টি গাড়ি কিনেছি। ৬১ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় এগুলো যাবে। প্রথম লটে আমরা ৬১টি কিনেছি, সেগুলোর বিআরটিএ সংশ্লিষ্ট কাজগুলো শেষ হয়েছে। ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে সেগুলো বিভিন্ন জায়গায় দিয়ে দেওয়া হবে। দ্বিতীয় ধাপের ১৮০টি রেজিস্ট্রেশনের জন্য আমরা বিআরটিএতে আবেদন দিয়েছি তাদের রুট পারমিট, রেজিস্ট্রেশন নম্বর, ডিজিটাল প্লেটের জন্য। গাড়ি সবগুলো কেনা শেষ। প্রথম ধাপের বিতরণে আমরা অনেকগুলো জেলা কাভার করেছি। অ্যানিমেল পপুলেশন, রোগের পরিমাণ যেখানে বেশি তা বিবেচনা করে এগুলো বিতরণ করা হচ্ছে, সব কটি বিভাগেই কাভার করছি। কোনো বিভাগ মিস করেনি, কম-বেশি যাচ্ছে। ১৮০টি আবেদন করেছি রেজিস্ট্রেশনের জন্য সেগুলো আগামী মাসে পেয়ে গেলে সেগুলোও বিতরণ করা হবে। এরই মধ্যে সরকার সব উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাকে করপোরেশন মোবাইল সংযোগ দিয়েছে, যেটা সেই উপজেলার জন্য নির্ধারিত। এটা উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাই সমন্বয় করবেন। প্রতি উপজেলায় একজন ভেটেরিনারি সার্জন আছেন, উপ-সহকারী কর্মকর্তা আছেন কয়েকজন। কোনো ধরনের সংকট দেখা দেবে না, এটি একটি কন্টিনিউয়াস প্রসেস। প্রতিটি গাড়ির পেছনে ব্যয় হচ্ছে ৫৩ লাখ টাকা। ৩৬০টি গাড়ি কিনতে ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম জাগো নিউজকে বলেন, দেশের প্রাণিসম্পদ খাতে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের অপ্রতিরোধ্য উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় প্রাণিসম্পদ খাত গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। প্রাণিসম্পদের উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশে প্রাণিচিকিৎসায়ও উন্নয়নের ধারা সূচিত হয়েছে। এক্ষেত্রে একটি নতুন দিগন্তের উন্মোচন হচ্ছে। উন্নত দেশের আদলে দেশে প্রথমবারের মতো ভ্রাম্যমাণ প্রাণিচিকিৎসা ক্লিনিকের মাধ্যমে পশুপাখির চিকিৎসাসেবা সহজীকরণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। দেশের ৬১টি জেলার ৩৬০টি উপজেলায় শিগগির এই ভ্রাম্যমাণ প্রাণিচিকিৎসা ক্লিনিক কাজ শুরু করতে যাচ্ছে। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে প্রাণীদের জরুরি চিকিৎসাসেবা তাৎক্ষণিকভাবে পৌঁছে দেওয়া।
তিনি আরও বলেন, উপজেলাভিত্তিক এ ভ্রাম্যমাণ ক্লিনিকগুলো গ্রামগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলে জরুরি চিকিৎসা ও পরামর্শসেবা দেবে। দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরে ফোন করলেই এখন থেকে খামারিদের দোরগোড়ায় দ্রুত পৌঁছে যাবে আধুনিক এ ক্লিনিক। ভ্রাম্যমাণ প্রাণিচিকিৎসা ক্লিনিকগুলোতে থাকবে রোগ নির্ণয়ের যন্ত্রপাতি, ওষুধ এবং চিকিৎসাসামগ্রী। এজন্য খামারিকে কোনো ফি বা অর্থ দিতে হবে না। জরুরি চিকিৎসার পাশাপাশি চিকিৎসক এবং দক্ষ কর্মীরা ক্লিনিক-ভ্যানে চেপে রুটিন করে নিজ নিজ উপজেলার অন্তর্ভুক্ত ইউনিয়ন ও গ্রামগুলোতে নিয়মিত পরিদর্শনে যাবেন। দেবেন চিকিৎসা, ওষুধ, পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ। সেই সঙ্গে গড়ে তুলবেন প্রাণিসম্পদ ও চিকিৎসা ডাটাবেজ।