হারিয়ে যাচ্ছে বেত শিল্পের নান্দনিক উপকরণ
উপকূলীয় জনপদ বরগুনার বেতাগীতে বেতের তৈরি পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ায় ঐতিহ্য হারাতে বসেছে এ শিল্প।
আধুনিক সভ্যতার দাপটে জীবনধারায় বিপুল পরিমান প্লাস্টিক সামগ্রীর ব্যবহারে এ এলাকার মানুষ গৃহস্থালির কাজে বেত শিল্পের তৈরিকৃত নান্দনিক উপকরণে আগ্রহ হারাচ্ছে।
প্লাস্টিকের পন্য ব্যবহারের ফলে বেত শিল্পের সহজলভ্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল না থাকায় এ পেশার কারিকররা জীবিকার তাগিদে বেঁছে নিচ্ছেন অন্য পেশা।
সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপচারিতায় জানা গেছে, এ উপজেলায় একটি পৌরসভাসহ ৭ টি ইউনিয়নে দেড় লক্ষাধিক জনসংখ্যার অধ্যুষিত এক যুগ আগেও ২ শতাধিকের উপরে পরিবার এ পেশায় সম্পৃক্ত ছিল।
কিন্তু অনেকেই এ পেশা ছেড়ে কৃষি, কাঠমিস্ত্রীর কাজ ও ব্যবসাসহ অন্য পেশা বেছে নিয়েছেন। বর্তমানে এ পেশায় মাত্র ৩৪ পরিবার সম্পৃক্ত রয়েছে।
পুরুষদের পাশাপাশি সংসারের কাজ শেষ করে নারী কারিগররাই বেত দিয়ে এই পণ্য বেশি তৈরি করে থাকেন। সাধারণত সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বেত দ্বারা এই সব পণ্য তৈরি করে থাকেন।
বেত থেকে তৈরি নান্দনিক সামগ্রী শিশুদের দোলনা, র্যাগ, পাখা, টোপা, ওরা, কুলা, মোরা, পুরা, দাড়িপাল্লা, ঝাঁপি, ফুলদানি, ফুলের ডালি, খাবার ঘরের ডাইনিং টেবিল, চেয়ার, টেবিল, সোফা সেট, খাট, মাছ ধরার পোলোসহ বিভিন্ন প্রকার আসবাবপত্র।
গ্রামাঞ্চলের সর্বত্র এসব নান্দনিক ব্যবহার ছিলো এক সময়। গ্রাম বাংলার কৃষকরা তাঁদের ধান চাল মাপার জন্য পুরা, ব্যবহার করতো।
গৃহস্থালী কাজে দৈনন্দিন রান্না করার জন্য চাল কি পরিমান নেওয়া হবে তা পুরা দিয়ে মাপা হতো। এছাড়া কৃষকরা গম, যব, ভূট্টা, বিভিন্ন প্রকার ডাল জাতীয় শষ্য পরিমাপ করা হতো।
আর এসব পুরা তৈরি হতো বিভিন্ন আকারের। একসের, দুইসের, পাঁচসের ও দশসেরের পুরা ছিল। গ্রাম বাংলার সনাতনধর্মের নারীরা এই পুরাকে লক্ষ্মীদেবির বর বা আর্শীবাদ হিসেবে মনে করতো।
আকার আকৃতি অনুযায়ী একটি বেত ৪০ থেকে ১০০ টাকায় কিনে নিচ্ছেন। বেতের ধরণ অনুযায়ী একটি বেত থেকে একসের পরিমানের ২ টি পুরা তৈরি করা যায়।
একজন কারিকরে দৈনিক অক্লান্ত পরিশ্রমে ৭ থেকে ১০ টি পুরা তৈরি করা সম্ভব এবং একটি পুরার বর্তমান মূল্য ১০০ থেকে ১৫০ টাকা।
বেতাগী সদর ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসন্ডা গ্রামের কারিকর কালু হাওলাদার জানায় , ‘ এ বেত শিল্পের পেশা ধরে রাখতে ধার-দেনা ও বিভিন্ন এনজিও টাকা ঋণ নিয়ে কাজ করছি।
তবে বেশি লাভ পাচ্ছি না কারণ এর চেয়ে কম দামে প্লাস্টিকের পন্য কিনতে পারে।’
এ পেশার সাথে সম্পৃক্ত একাধিক ব্যক্তি জানান,’ আমাদের এই শিল্পটির উন্নতির জন্য সরকারীভাবে অল্প লাভে ঋণ দেয়া হয় তাহলে এই শিল্পটি টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে।
আধুনিক সভ্যতার প্লাস্টিক সামগ্রীর দাপটে বরগুনার বেতাগী উপজেলার ইউনিয়ন ও পৌর শহরে এ পেশার সাথে বসবাসরত ব্যক্তিরা হারাতে বসেছে বেত শিল্পের ব্যবহার।
বেতের তৈরি বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ায় ভালো নেই এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত কারিগররা। তবুও বাপ-দাদার এই পেশাকে এখনও জীবিকার প্রধান বাহক হিসাবে আঁকড়ে রেখেছে উপজেলার কিছু সংখ্যক পরিবার।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. ইকবাল হোসেন বলেন, এ পেশার সাথে সম্পৃক্ত কৃষক ও কারিকরদের আর্থিক সহায়তা প্রদান এবং অনুপ্রেরণা হিসেবে যথাযথ প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করানো প্রয়োজন।’
এ বিষয় পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের প্রফেসর ড. সন্তোষ কুমার বসু বলেন,’ বেত একপ্রকার একবীজপত্রী গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ।
এর বৈজ্ঞানিক নাম Calamus tenuis, যা Arecaceae পরিবারভুক্ত। এ জাতীয় উদ্ভিদ বাড়ির আশেপাশে ঝোপঝাড়ে একটু নিচু জমিতে জন্মানো সম্ভব। বর্তমান সভ্যতায় এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা এগিয়ে আসা দরকার।’
এ বিষয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সুহৃদ সালেহীন বলেন, ‘গ্রামীণ ঐতিহ্য ও এসব ক্ষুদ্র পেশাজীবীদের পুর্নবহালের জন্য আগ্রহীদের মাঝে সহজশর্তে ব্যাংক ঋণ প্রদানের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’