বরিশালে চার মাসেও পল্লিচিকিৎসক হত্যায় শনাক্ত হয়নি জড়িতরা
বরিশাল নগরের বিমানবন্দর থানার গড়িয়ারপাড় এলাকার ওষুধ ব্যবসায়ী ও পল্লিচিকিৎসক আবদুর রহমান খান (৬৯) হত্যাকাণ্ডের চার মাস পার হলেও হত্যার রহস্য উদ্ঘাটিত হয়নি এবং হত্যার সঙ্গে জড়িত কাউকে শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ।
পুলিশ বলছে, নিহত আবদুর রহমান একজন পরোপকারী ও ভালো মানুষ হিসেবে এলাকার সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ছিলেন। তাঁর দৃশ্যমান কোনো শত্রুও ছিল না। আর খুনের ঘটনাটি ঘটেছে রাতে সবার অগোচরে। এ কারণে খুনিদের শনাক্ত করাটা কঠিন হয়ে পড়েছে। তবে পুলিশ হাল ছাড়েনি, নানা মাধ্যমে আসামিদের শনাক্ত করতে জোর চেষ্টা করছে।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঘটনার সময়ের দোকান, সড়ক ও আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। এর ভিত্তিতে স্থানীয় চারজন তরুণকে আটক করা হয়েছিল। কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদে কোনো তথ্য মেলেনি। সম্প্রতি তাঁরা জামিনে মুক্তিও পেয়েছেন। আবদুর রহমানের লাশ উদ্ধারের দিন বাড়ির আঙিনা থেকে দুটি সিগারেটের গোড়া (ফিল্টার) উদ্ধার করা হয়। সেগুলো ঢাকায় পাঠিয়ে ওই চার তরুণের ডিএনএ নমুনা পরীক্ষা করে দেখা হবে। সেই পরীক্ষার প্রতিবেদন এখনো পাওয়া যায়নি।
গত বছরের ৭ অক্টোবর রাতে আবদুর রহমান খান গড়িয়ারপাড় বাজারে তাঁর ওষুধের দোকান বন্ধ করে দিবাগত রাত একটার দিকে একই এলাকায় বাড়িতে ফেরার জন্য রওনা হন। ভ্যানে করে একাই তিনি বাড়ি ফিরছিলেন। সিসিটিভির ফুটেছে দেখা যায়, আবদুর রহমান দোকান বন্ধ করে মূল সড়কের পাশে গিয়ে ভ্যানে ওঠে বসেন। ভ্যানটিতে তিনি একাই ছিলেন। এরপর তিনি ভ্যান থেকে বাড়িতে ঢোকার সরু রাস্তার পাশে নামেন।
ভ্যানচালককে আবার গড়িয়ারপাড় বাজারের দিকে একা ভ্যান চালিয়ে চলে যেতে দেখা যায়। ভ্যান থেকে আবদুর রহমান বাড়ির সামনের সড়কে নামলেও তিনি ওই রাতে আর বাড়িতে ফেরেননি। পরে তাঁর ছোট ছেলে আবদুল্লাহ মুঠোফোনে ফোন করলেও আবদুর রহমান ফোন ধরেননি। কাজে ব্যস্ত আছেন ভেবে আবদুল্লাহ ঘুমিয়ে পড়েন।
ভোর সাড়ে ৫টার দিকে আবদুল্লাহর মা (আবদুর রহমানের স্ত্রী) ফজরের নামাজ আদায়ের জন্য ঘুম থেকে জেগে দেখেন আবদুর রহমান বাড়িতে ফেরেননি। তিনি আবদুল্লাহকে ঘুম থেকে জাগিয়ে বাবার খোঁজ নিতে তাগিদ দেন।
আবদুল্লাহ বাড়ির উঠানে গিয়ে দেখেন, তাঁর বাবার জুতা পড়ে আছে। এরপর বাড়ির মূল ফটকের বাইরে গিয়ে দেখেন বাড়ির নিরাপত্তাপ্রাচীরের সঙ্গে হেলান দিয়ে জবুথবু হয়ে বসে আছেন তাঁর বাবা। বাবার এমন অবস্থা দেখে আবদুল্লাহ চিৎকার দিলে স্বজন ও আশপাশের লোকজন এসে ধরাধরি করে বাড়িতে নিয়ে দেখেন আবদুর রহমান মারা গেছেন। বিষয়টি বিমানবন্দর থানায় খবর দিলে পুলিশ এসে লাশটি উদ্ধার করে বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠায়। ময়নাতদন্তে তাঁকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ ঘটনায় নিহত আবদুর রহমান খানের বড় ছেলে মারজানুর রহমান বাদী হয়ে বরিশাল বিমানবন্দর থানায় অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন।
মামলার চার মাস পার হলেও হত্যাকাণ্ডে জড়িত কাউকে গ্রেপ্তার কিংবা কারা এর সঙ্গে জড়িত, তা এখনো শনাক্ত করা যায়নি। ফলে এ মামলার ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায় আছেন নিহত আবদুর রহমান খানের স্বজনেরা।
মামলার বাদী মারজানুর রহমান রহমান বলেন, ‘মামলাটি খুবই জটিল। পুলিশ ক্লু বের করার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করেছে এবং এখনো করছে। কিন্তু কোনো কূলকিনারা পাচ্ছে না। জানি না এ মামলার ভবিষ্যৎ কী?’
নিহত আবদুর রহমান খানের পরিবার জানায়, তাঁরা বহু আগে জমি কিনে গড়িয়ার পাড় এলাকায় বাড়ি করেছেন। ওই জমির কিছু অংশ জালজালিয়াতি করে একটি পক্ষ কাগজপত্র তৈরি করে স্থানীয় একটি জমি বিক্রির প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রির জন্য একটি বায়নাপত্র তৈরি করেছে।
এ নিয়ে বেশ কয়েক বছর আগে প্রতিষ্ঠানটি তাঁদের জমিতে সাইনবোর্ড দিয়েছিল। পরে সেই সাইনবোর্ড তাঁরা তুলে ফেলে। এরপর আর কোনো ঝামেলা হয়নি। তবে আবদুর রহমান খুন হওয়ার পর আবার ওই জমির একটি বায়নাপত্র তৈরি করা হয়েছে। পুলিশ পক্ষটিকে ডেকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। কিন্তু তাদের কাছ থেকেও কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পায়নি।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও বরিশাল বিমানবন্দর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. লোকমান হোসেন বলেন, সম্প্রতি মামলাটির তদন্তভার পেয়েছেন তিনি। এর আগে যিনি তদন্ত করেছেন, তিনি বদলি হয়ে গেছেন। আসলে মামলাটি পুরোপুরিই ক্লুলেস। এ কারণে নানাভাবে চেষ্টা করছেন ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করতে। এতে হয়তো সময় লাগবে, তবে আসামিদের শনাক্ত করা যাবে।
মারজানুর রহমান বলেন, ‘আমার বাবা নিরীহ ও পরোপকারী ছিলেন। পল্লিচিকিৎসক হিসেবে তাঁর ব্যাপক খ্যাতি ছিল। লোকজনকে তিনি সাধ্যমতো চিকিৎসা দিতেন। তাঁর সঙ্গে কারও কোনো বিরোধের কথা শুনিনি। শুধু ওই জমি নিয়ে কিছুটা বিরোধ ছিল।
এখন কী কারণে তিনি হত্যার শিকার হলেন, কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি ঢাকায় একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে কাজ করি। বাড়িতে মা ও ছোট ভাই একা থাকে। এখন তারাও নিরাপত্তাহীন। আমাকে প্রায় সময়ই মামলার জন্য বরিশালে দৌড়াতে হচ্ছে, কূলকিনারা না পেয়ে আমিও ক্লান্ত।