৮ই ডিসেম্বর বরিশাল মুক্ত করতে যেভাবে দায়ীত্ব পালন করেন সাব-সেক্টর এম.এ হক
৮ই ডিসেম্বর বরিশালকে মুক্ত করার জন্য সেদিন যে ভূমিকা পালন করেছিলেন বৃহত্তর বরিশাল সাব-সেক্টর মুক্তিযোদ্ধা সহ-অধিনায়ক এম.এ হক বীর বিক্রম।
বরিশাল মুক্ত হওয়া প্রসঙ্গে স্মৃতিচারন করে বরিশাল জেলা মুত্তিযোদ্ধা সংসদে বসে ১৯৭১ সালের সহ-অধিনায়ক মুক্তিযোদ্ধা বৃহত্তর বরিশাল সাব-সেক্টর এম.এ হক বলেন, ১৯৭১ সালে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ভোলা, ঝালকাঠী সহ ৯নং সেক্টরের বৃহত্তর বরিশাল সাব সেক্টর এর সব কয় উপজেলা শত্রুমুক্ত করার জন্য ৬ই ডিসেম্বর আমাদের নিজস্ব গোয়েন্দা সংবাদের মাধ্যমে জানতে পারি যে যশোর থেকেহানাদার বাহিনীর প্রায় এক ব্রিগেড সৈন্য বরিশালের ওয়াপদা কলোনিতে একত্রিত হয়েছে এবং তারা ১৬টি নৌযান যোগে (লঞ্চ, স্টিল বডি ও কাঠবডি লঞ্চ) বরিশাল কির্তনখোলা নেভাল জেটিতে একত্রিত হয়েছে।
৭ই ডিসেম্বর দিবাগত রাতে ঐলঞ্চগুলি সমরস্ত্রে সজ্জিত করে গোলাবারুদ সহ প্রায় এক ব্রিগেড সৈন্য এবং তৎকালীন রাজাকার কমান্ডার শাজাহান চৌধুরী সহ একত্রে ৮ই ডিসেম্বর ভোর ৬টায় ঢাকার উদ্দেশ্যে গমন করবে।
এই সংবাদের ভিত্তিতে আমরা আমার সাবসেক্টরের বেইজ কমান্ডারের সহিত বেইজ কমান্ডার মজিদ খান, সুলতান মাস্টার,রতন শরীফ,কুদ্দুস মোল্লা, নিজাম উদ্দিন,আব্দুল মান্নান সিকান্দার এবং টাউন সুইসাইড স্কোয়াড কমান্ডার রেজা-ই সত্তার ফারুক) গোপন মিটিং করি।
উক্ত মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয় যে, পাকিস্তনি হানাদার বাহিনীকে ৮ ডিসেম্বর প্রতিরোধ করতে হলে বিমান সাপোর্ট ছাড়া কোনভাবেই সম্ভব নয়। সেসময় হানাদার বাহিনী ভারি অস্ত্রে সজ্জিত।
এব্যাপারে খুলনা যেহেতু শত্রুমুক্ত সেখানে ৯নং সেক্টর কমান্ডার খুলনায় অবস্থান করছে তাকে যেকোন উপায়ে সংবাদ পাঠিয়ে বিমান সাপোর্ট চাওয়া খুবই জরুরী।
এমতাবস্তায় আমরা ৭ই ডিসেম্বর বরিশালের শাহেবের হাট থেকে উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে নৌবহর নিয়ে নতুন বাজার খালের মধ্যে প্রবেশ করি।
সেখান থেকে নিশ্চিত হই যে বরিশাল শহরেরপুলিশ লাইনের সামনের রাস্তায় দক্ষিনে ওয়াপদা কলোনিতে শত্রু সৈন্যরা অবস্থান করছে এবং রাস্তার উত্তর দিক সম্পূর্ণ শত্রু মুক্ত।
যেহেতু ঐদিন রাতে তাদের ঢাকায় যাওয়ার প্রস্ততি এর পেক্ষিতে তারা রাস্তা অতিক্রম করে উত্তর দিকে যাওয়ার কোন সাধ্য নেই তাই আমরা নতুন বাজার থেকে সার্কিট হাউজ বরিশাল বরিশাল সাবসেক্টর হেড কোয়াটার স্থাপন করি।
এবং সিদ্ধান্ত মোতাবেক বিকাল ৪টার দিকে আমাদের ৯নং সেক্টর কমান্ডার মেজর এম.এ জলিল এর সাথে যোগাযোগ কিভাবে করা যায় তার মাধ্যম খোজ করতে থাকি।
এক প্রর্যায়ে পুলিশ লাইনের ওয়ারলেস টাওয়ার মুক্ত আছে কিনা এবং মুক্ত থাকলে তা কিভাবে চালু করা যায় সেই ব্যাপারে আমি সহ অধিনায়ক নিজে ওয়ারলেস টাওয়ারে যাই এবং বুবি ট্রাপস্ বা কোন ফাদ পাতা অঅছে কিনা সে বিষয়ে পরিক্ষা-নিরিক্ষা করে নিশ্চিত হই যে,মুক্ত আছে সেসময় ওয়ারলেস সচল করার চেষ্টা করি । এক প্রর্যায়ে সচল হয় কিন্ত সঠিকভাবে ষ্টেশন ধরা যাইতেছে না। এব্যাপারে সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপটের শাহজাহান ওমরকে অবহিত করি।
তিনি আমাকে বলেন আমিতো হেটে যেতে পারব না (পায়ে প্লাষ্টার করা)। আমাকে কোন রকম ওয়ারলেসে ি নয়ে যাবার ব্যবস্থা কর।
তাকে একটা ওপেন জিপের মধ্যে ওয়ারলেসে নিয়ে যাই। পরে তিনি ওয়ারলেস অপরেট করেন (তিনি একজন পাকিস্তান সেনা বাহিনীর সিগনাল কোরের অফিসার ছিলেন)।
কাজেই অতি সহজেই খুলনায় সেক্টর কমান্ডার মেজর এম.এ জলিল এর সহিত যোগাযোগ করতে সক্ষম হন এবং কুশল বিনিময় করেন এবং বলেন হানাদার বাহিনীর এক ব্রিগেড সৈন্য বরিশালের ওয়াপদা কলোনীতে অবস্থান করছে।
আমরা বরিশাল সার্কিট হাউজে অবস্থান করছি। বরিশালের পুলিশ লাইনের সামনের রাস্তার দক্ষিণে হানাদার বাহিনীর অবস্থান এবং উত্তরে আমাদের অবস্থান
এসময় তাকে বলা হয় আজকের (৭ই) ডিসেম্বর) রাতে বিপুল পরিমান সমরস্ত্রে সজ্জিত হয়ে (৮ই) ডিসেম্বর ভোর ৬টায় কির্তনখোলা নদী দিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে গমন করবে।
হানাদার বাহিনী ভাড়ী অস্ত্রের মুখে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের হানাদার বাহিনীর প্রতিরোধ করা সম্ভব না। এব্যাপারে তাদের প্রতিরোধ করতে হলে ফাইটার বিমান প্রয়োজন।
এমতাবস্থায় সেক্টর কমান্ডার মেজর এম.এ জলিল অপেক্ষা করতে বলেন। আমরা আধা ঘন্টা অপেক্ষা করি এবং মেজর এম.এ জলিল এবং আমাদের সাথে পুনরায় যোগাযোগ করে বলেন এয়ারবেইজ ইন্ডিয়ার সাথে কথা হয়েছে ঠিক ৮ই ডিসেম্বর ভোর ৬টায় ৩ খানা ফাইটার জেট পৌছাবে।
তোমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের কির্তনখোলা নদীর দুই তীরে নন্দীর বাজার পর্যন্ত ডেপ্লয় সহ (অবস্থান করা) কর এবং বরিশাল শহরের উচু জায়গায় গুলোতে বড় বড় সাদা পতাকা উড়িয়ে দেও যাহাতে শহরে উপরে কোন বোমা বর্ষন না করে।
এব্যাপারে আমরা ৭ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে মুক্তিযুদ্ধাদের ডেপ্লয় সহ উচু জায়গা গুলেতে বড় বড় সাদা পতাকা উড়িরে দেই।
এবং শহরে কার্ফিও জারি করি যে, পুনরায় নির্দেশ না পর্যন্ত কেহ ঘড়ের বাহিরে বেড় হবেন না। আমরা যথারিতি অপেক্ষা করতে থাকি।
রাত শেষ ভোর হয় ৮ই ডিসেম্বর ভোর ৬টায় হানাদার বাহিনী সমরাস্ত্রে সজ্জিত ১৬টি নৌযান নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা করে।
ঠিক ৬টা ৩ মিনিটের সময় বরিশাল শহরের দক্ষিণ আকাশে ৩টি ফাইটার জেট বিমান দেখা যায়। বিমান ৩টি বরিশাল শহর প্রদক্ষিণ করে এবং লঞ্চ টারমিনালে একটি বোমা ফালানোর কারনে টারমিনাল তলিয়ে যায়।
আমরা কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়ি। কিন্ত দেখা গেল বিমান ৩টি দক্ষিণের দিকে চলে গেছে। হঠাৎ দক্ষিণ দিক থেকে আবার নিচু দিয়ে শত্রু নৌবহরে চড়াও হয়।
প্রথম ফাইটারটি ব্রাস্টফায়ার করে। দ্বীতিয়টি বোম্বিং এবং তৃতীয়টি ব্রাস্টফায়ার করে এভাবে ৩০ মিনিট বোম্বিং ও ব্রাস্টফায়ার করে নৌযানগুলোকে নাস্তানোবোধ করে দেয়।
এসময় শত্রু সৈন্যরা সাতরিয়ে তীতে উঠে তাদেরকে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা পূর্ব থেকে ডেপ্লয় করা হত্যা করার মধ্যে দিয়ে বরিশাল শত্রুমুক্ত হয়।
উড়ানো হয় স্বাধিন বাংলাদেশের পতাকা।এসময় জয় বাংলা শ্লোগানে মুখরিত হয় পুরো বরিশাল শহর এবং ভোলা,ঝালকাঠী সহ সকল উপজেলা